৩২ বছরে পার্টির নেতাদের চরিত্র কেমন বদলেছে? ১৯৭৭ সালে যারা পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন গ্রামের দিকে- তাদের সবাই স্কুল শিক্ষক। দেশভাগের ফলে ওপার বাংলা থেকে এসে উদবাস্তুর জীবনসংগ্রামে উত্তীর্ণ হয়েছেন তারা। তত্ত্ব বলতে সম্বল মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের দু চারিটি চটি বই-কিন্ত দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে জীবনের অভিজ্ঞতা অনেক বেশী। বাংলাদেশ থেকে এসে লড়াই করার সেই কঠিন অভিজ্ঞতা নিয়েই পশ্চিম বঙ্গে সিপিএমকে ইনারা দাঁড় করিয়েছিলেন। মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ বোঝার চেষ্টা তারা করেন নি-জীবনের অভিজ্ঞতায় তাদের চিনিয়েছিল শ্রেনীতত্ত্ব। আর দেশভাগের জন্যে ছিল কংগ্রেসের ওপদ অদম্য রাগ সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। এটাই ছিল তখন সিপিএমের নেতৃত্বের ভিত্তি। কয়েকশো টাকা শিক্ষকদের বেতন-তাও নিয়মিত দিত না কংগ্রেস সরকার।
সোভিয়েত ইউনিয়ান তখন তাদের চোখে স্বর্গরাজ্য। বাংলায় বিনা পয়সায়, খুব দামী কাগজের সোভিয়েত ইউনিয়ানের পত্রিকা গুলো আসত। গ্লসি পেপার। দারুন প্রিন্টিং। সুন্দর সুন্দর হাসপাতাল, স্কুল আর শিল্পের ছবি। পৃথিবীর বুকে স্বর্গের ডাক। নাম স্যোশালিজম।
১৯৮৫ সাল থেকেই বিপদটা আসছিল। আমার মামার বাড়ি কালনায়। কালনা থেকে হাওড়া যেতে দুদিকে দেখতাম দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা কারশেড। শিয়ালদাহ থেকে কৃষ্ণ নগরে আসতেও দুদিকে শুধু বন্ধ জুটমিল। কলকাতা শহরতলি তখন শিল্প শ্বশান।
আসলে যারা সিপিএমের নেতৃত্ব তখন ছিলেন-তাদের কেওই ব্যাবসার সাথে যুক্ত ছিলেন না। ফলে অর্থনীতি এবং ব্যাবসা ব্যাপারটা এরা তখন একদম বুঝতেন না। মনে করতেন সরকারি উদ্যোগে সব হয়। ফলে সীমিত ক্ষমতার মধ্যে জীবিকা তৈরীর জন্যে পশ্চিম বঙ্গ সরকার জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ-অনেক ব্যাবসা শুরু করল-এবং সেগুলো চলার আগেই রুগ্ন হয়ে গেল। সরকার রেস্টুরেন্ট বা টুরিস্ট ব্যাবসা চালাতে গেলে যা হয় আর কি। না-ওই ভাবে পশ্চিমবঙ্গে জীবিকা সংস্থান করা গেল না।
কারখানা বন্ধ। কর্পরেট অফিস কোলকাতা থেকে উঠে মুম্বাই চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে লোকেরা এসেই চলেছে এবং সিপিএমের দাক্ষিন্য তারা রেশন কার্ড করে এ দেশের নাগরিক ও হয়ে যাচ্ছে। নব্বইএর দশকে গোটা পশ্চিম বঙ্গ আটকে গেল। ১৯৭৭ সালে পশ্চিম বঙ্গ শিল্পে চতুর্থ-১৯৮৬ সালে মাত্র ন বছর সিপিএম শাসনে নেমে গেল শেষের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে। নিজেদের ব্যার্থতা ঢাকতে মোড়ে মোড়ে সিপিএমের বাহিনী ( তখনো হার্মাদ বাহিনী হয় নি) মাইকে করে কেন্দ্রের বঞ্চনা গাইত। ভূমি সংস্কারের ফলে গ্রামে তখনো সিপিএম প্রবল জনপ্রিয়-কিন্ত কংগ্রেস মরে যায় নি। বরং ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরার মৃত্যুর সময় কংগ্রেস ১৬ টি আসন পেলেও, সংখ্যার বিচারে সিপিএমের থেকে বেশী ভোট পেয়েছিল। ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর মৃত্যু বাংলার বিরোধি রাজনীতিকে ১৫ বছর পিছিয়ে দেয়। রাজীব গান্ধীর মৃত্যু না হলে, ১৯৯৫-৯৭ সালেই সিপিএমের শেষ ঘণ্টা বেজে যেত।
কিন্তু রাজীবের মৃত্যুর পর বাংলার বিরোধি রাজনীতির দুর্দিন ঘনিয়ে আসে। সোনিয়া গান্ধী না হাল ধরা পর্যন্ত, কিছু নেতাদের বালখিল্যতায় কংগ্রেস ধ্বংশ হতে থাকে। পশ্চিম বঙ্গের কিছু কংগ্রেস নেতা সিপিএমের সাথে আঁতাত করে। কংগ্রেসে সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাবে না দেখে মমতা ব্যানার্জী তৃণমুল গঠন করেন। এই সময় এই নতুন দলটির বিজেপির খুব প্রয়োজন ছিল। তারা মমতাকে বিপুল অর্থ যোগায় প্রাথমিক ভাবে তৃণমূলকে দাঁড় করানোর জন্যে। বিজেপির সাথে তৃণমূল চলে যাওয়ায়, সিপিমের আরো সুবিধা হয়-কারন এতে সংখ্যালঘু ভোট সিপিএমে নিশ্চিত হয়।
১৯৯৫ সাল থেকে রাজ্য রাজনীতিতে জমি দখলের জন্য তীব্র হিংসার সূচনা হয়। এটা এক মাত্র নিও-ম্যালথেসিয়ান তত্ত্ব দিয়েই বোঝা যাবে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গের জনসংখ্যা বেড়েছে ৭৮% ( যার প্রায় সবটাই গ্রামে এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে)-কিন্ত পতিত জমি থেকে কৃষিজমি বেড়েছে মোটে ৬%। অর্থাৎ আগে যেখানে গ্রামে জনপ্রতি 0.34 একরে জীবিকা নির্বাহ করতে হত, ১৯৯৫ সাল সেটা নেমে এল 0.21 একরে। গ্রামের মানুষের চাহিদা বাড়ল-কিন্ত উপায় কমল। ফলে ভূমিহীন ডেইলি লেবারে সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিম বঙ্গে বাড়ল সব থেকে বেশী।
শিল্প নেই-অথচ গ্রামে ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে ৯০এর দশকে। ফলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে যেখানে কৃষি মজুরীর পরিমান ১৯৮০ সালের রোজ ১০ টাকা হিসাব থেকে ২০০৭ সালে ৯০-১২০টাকা হল, আমাদের রাজ্যে হয়েছে ৫০-৭০ টাকা। গুজরাটে যেখানে কৃষি শ্রমিকরা বছরে ৯০ দিন কাজ পায়, আমাদের রাজ্যে পেল মোটে ২০-৩০ দিন।
এই আর্থ সামাজিক পরিপেক্ষিতেই আমাদের কেশপুর, নন্দীগ্রাম -সিঙ্গুর বুঝতে হবে। সিঙ্গুরে যাদের জমি ছিল-তাদের প্রচুর লাভ হয়েছে-কিন্ত সিপিএমের শিল্পায়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল ভূমিহীন, শিক্ষাহীন এই প্রান্তিক লেবাররা।
সিপিএমের নেতৃত্বের এর মধ্যে গুণগত পরিবর্ত্তন হয়েছে। যারা কম্প্রোমাইজ করতে পারেন নি-বেড়িয়ে গেছেন। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই সিপিএম নেতাদের ভাল বাড়ি হতে লাগল। সরকারি চাকরি একমাত্র তাদের ফ্যামিলির লোকদের জন্যেই বরাদ্দ। বুদ্ধদেব বাবু শিল্প বন্ধু ইমেজ নেওয়ার পর, মধ্যবিত্ত্ব শ্রেনীর সমর্থন ও সিপিএম পেল। কিন্ত পার্টির নেতৃত্ব ভুলে গেল বছরে কুড়িদিন কাজ পাওয়া লোকেদের কথা-
কেন ভুলে গেল? কারন যারা পার্টিতে টিকে ছিল বা সদ্য ঢুকেছিল তাদের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষন করা দরকার-সবার ধান্দা দুটো কামিয়ে নেওয়া। উদাহরন দিচ্ছি। ১৯৯৬ সালে এস এফ আই এর স্টেট কমিটির এক নেতা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন-পার্টির হোলটাইমার ও ছিলেন। '৯৮ সালে দেখা হল। এর মধ্যে তিনি যে মেয়েটিকে তিনি ভালবাসতেন তাকে প্রাথমিক স্কুলে ঠিক ঢুকিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পুরীতে তার হনিমুন করার টাকাটাও এক স্থানীয় মারোয়ারী দিয়েছে-কারন মিউনিসিপালিটির স্থানীয় কাউন্সিলার তখন তিনি। ছেলেটি কি খুব অসৎ ছিল? আমার একবারও মনে হয় নি-ওর জাস্ট মনে হয়েছে লোকে দিচ্ছে, নিতে ক্ষতি কি? অথচ আমি দেখেছি এই ছেলেটিই এক সময় মাসে মাত্র ৮০০ টাকা হোলটাইমার মাইনে সম্বল করে পাঁশকুড়া পার্টি অফিসে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকত। আস্তে আস্তে প্রতিটা পার্টি অফিসের নির্বাচনে স্থানীয় ব্যাবসায়ী এবং কনট্রাক্টরদের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মেদিনীপুরে জোনাল এবং লোকাল নির্বাচনে পুলিশ লাগত-কারন খুনোখুনি হত। কিসের জন্যে লোক্যাল কমিটির নির্বাচনে খুনোখুনি? শুধুই ক্ষমতা? না। আসলে জিতলে জেলাতে যে শিল্প বা ব্যাবসা করতে আসবে, তার কাছ থেকে কিছু কামিয়ে নেওয়ার ধান্দা। ফলে ১৯৯৮ সালেই পার্টি দরিদ্র জনসাধারন থেকে বিচ্ছিন্ন-তাদের নতুন ভোটার বেস ফুলে ফেঁপে ওঠা নেতাদের ফ্যামিলি এবং বাঙালী মধ্যবিত্ত।
সিপিমের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ কিন্ত ভোটে প্রতিফলিত হয় নি। কারন বিজেপির সাথে থাকায় সংখ্যালঘু ভোট মমতা পাচ্ছিলেন না। গ্রামে কংগ্রেসের সংগঠন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়-সেখানে চলে পার্টির নিরবিচ্ছিন্ন ডিক্টেটর শিপ। একটু অন্যসূরে গাইলেই বাড়ি পোড়ানো, মেয়েদের ধর্ষন সিপিএমের ক্যাডাররা চালিয়েছে। পশ্চিম বঙ্গে পুলিশ প্রশাসন সব কিছুই পার্টির দখলে-ফলে পার্টির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কেও ছিল না।
কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে এই অধঃপতনকে নেতারা শীর্ষ স্থানীয় নেতারা প্রশ্রয় দিলেন কেন? একদম হাতে নাতে ধরা পড়লে কিছু লোককে তাড়ানো হয়েছে-কিন্ত তাতে কি? সেত ভাসমান হিমশৈলের ওপরটাও না।
কেন নেতারা এই অধপতন আটকালেন না? আরে তারা নিজেরাই ত চূড়ান্ত অধঃপতিত তখন। প্রতিটা নেতা নিজের ছেলে, বৌমাদের চাকরি-ব্যাবসা ইত্যাদিতেই সময় দিতেন বেশী। পশ্চিম বঙ্গ ডুবছিল সব দিক দিয়ে-তাতেও তাদের মাথায় চিন্তা গজায় নি। কারন সংখ্যালঘু ভোটের নিশ্চয়তা ছিল। ২০০১ সাল থেকে দলে দলে গ্রামের বেকার ছেলেরা অন্যরাজ্যে পাড়ি জমায়। এর ফলে পশ্চিম বঙ্গের গ্রামীন অর্থনীতি যেমন চাঙ্গা হয়-ঠিক তেমনি, গ্রামের লোকেরা প্রথমবারের মতন শোনে অন্যান্য রাজ্য পশ্চিম বঙ্গ থেকে কত এগিয়ে। পশ্চিম বঙ্গ অন্যান্য রাজ্য থেকে এগিয়ে-এই ধাপ্পাবাজি ধরে ফেলে গ্রামের লোকেরা এই সব বহিরাগত যুবকদের অভিজ্ঞতা থেকে। আমাদের রাজ্যে রাজমিস্ত্রীর রোজ ১২০টাকা-কেরালাতে ৪০০টাকা, মহারাষ্ট্রে ৩২০টাকা। এইসব তথ্য গ্রামে ঠিকই পৌছায়। ফলে ধাপ্পাবাজি চাপা থাকে না।
এর পরে ১৬-১৮ ঘণ্টা লোডশেডিং সহ্য করে যখন পাড়ার নেতারা মাইকে ফুঁকদেন, এই রাজ্য বিদ্যুতে দ্বিতীয়-তখন কাটা ঘায়ে নুনে ছিটে পড়ে জনসাধারনের। ক্ষুদ্র শিল্পের মালিকদের করুন অবস্থা এই রাজ্যে। আমার জেঠামশাই গ্রামে তেল-চাল-গমকল চালান। তাদের ইনকাম উত্তোরোত্তর কমেছে। তারপরে লোডশেডিং এর জন্যে ব্যাবসায় বিশাল ক্ষতি হয়। যাদের জমি আছে-ডিজেল পুড়িয়ে জল দিতে হচ্ছে-কারন বিদ্যুত নেই। জল-সারে এত খরচ হলে, লেবারদের টাকা দেবে কোত্থেকে? ফলে কৃষির সাথে যুক্ত এক বিশাল জনসংখ্যা এই রাজ্যে ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন। তাদের কথা ভাবার মতন পার্টিতে কেও নেই। থাকলে আমরা দেখতাম সরকার কৃষিতে জল এবং বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানের জন্যে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে। কি করে থাকবে? নেতাদের ত একটাই ধান্দা-তার নিজের বা ছেলের ব্যাবসা বা চাকরী।
নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুর নিয়ে অনেক শহুরে বাবু লাফাচ্ছে। আমি নিজে নদীয়া মুর্শিদাবাদে অনেক চাষিদের প্রশ্ন করেছি-তারা কি ভাবছেন। না-তারা নন্দীগ্রাম নিয়ে ভাবেন নি। ন্যানো নিয়েও নয়। আমেরিকা-ভারত নিউক্লিয়ার চুক্তি নিয়েও না। কংগ্রেসের হাওয়া ফাওয়া কিস্যু ছিল না।
তারা বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন বিদ্যুত এবং জলের অভাবে। অনেকে জমিতে আম কাঁঠাল বাগান করে দিচ্ছেন। কারন চাষ করে লাভের সম্ভাবনা নেই। তার থেকে লোকসান না খেয়ে, যা দুপয়সা আসে। কিন্ত তাদের ইনকাম সাংঘাতিক ভাবে কমে গেছে। রোগ হলে চিকিৎসা করার পয়সা নেই। আর তাদের বাড়ির পাশেই নেতাদের তিনতালা বাড়ী উঠেছে।
অর্থাৎ পার্টির সামনে এখন সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে রাজ্যে উৎপাদনের সমস্যা। পশ্চিম বঙ্গে এখন সবাই সেকুলার। মুসলিম ভোট আর ওভাবে পাওয়া যাবে না। তাদের প্রায় সবাই ভূমিহীন শ্রমিক। উৎপাদন কি ভাবে বাড়াতে হয়-সেটা লেনিনবাদে লেখা নেই! ফলে এই মুহুর্তে তারা যদি রাজ্যে বিদ্যুত জল, রাস্তা, কৃষকদের জন্যে ক্ষুদ্র ঋণ ইত্যাদি নিয়ে না ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলে ২০১১ সালের ভোটে ৩০টা সিট ও উনারা পাবেন না। উচিত ও না।
প্রশ্ন হচ্ছে সিপিএমের কোন নেতা এই কাজ করবে? প্রকাশ কারাত থেকে নীচু স্থানীয় সব নেতাই নিজের ধান্দা নিয়ে ব্যাস্ত!
No comments:
Post a Comment