
চৌত্রিশ বছরের একটি ধ্বংসপ্রায় অট্টালিকাকে মেরামত করে বসবাসযোগ্য করার জন্যে কি ছমাস যথেষ্ট?
অনেকেই বলবেন "না"।
সিপিএম পশ্চিম বঙ্গে যে অচলায়তনের জন্ম দিয়েছিল, তা সচল করতে হয়ত ছমাস যথেষ্ট নয়। কিন্ত দিনের প্রথম সূর্য্যের রঙে যেমন বাকী দিনটির আকাশ কিছুটা অনুমান করা যায়, মমতাতন্ত্র কোন দিকে গড়াবে-তার একটা আভাস আমরা পাচ্ছি। এবং সেই সিগন্যালগুলি খুব অভিপ্রেত বা আশাব্যঞ্জক না। মমতাকে নিয়ে বাংলা মিডিয়ার হ্যাংলামো অব্যাহত-গণশক্তির নাকি কান্নাও ক্রমাগত-কিন্ত মমতা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা মিডিয়াতে আশ্চর্য্যজনক ভাবে অনুপস্থিত। দেউলিয়া বাংলা মিডিয়ার কাছে অবশ্য প্রত্যাশার কলসটিও নেহাৎই ছিদ্রপূর্ণ।
প্রথমেই লিখি রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে। কোষাগার শুন্য। কেন্দ্রের কাছে মমতা বেইল আউট প্যাকেজ চাইছেন। কিন্ত সাংবিধানিক বাধা আছে। কেন্দ্র রাজ্যের উন্নয়নের জন্যে টাকা দিতে পারে-কিন্ত রাজ্য সরকারের বেতন মেটানোর জন্যে নিয়ম বহির্ভুত অতিরিক্ত টাকা দিতে পারে না। ফলে অসীম দাশগুপ্ত যেভাবে পশ্চিম বঙ্গকে ডুবিয়েছে বাজার থেকে উচ্চসুদের ঋণ নিয়ে-অমিত মিত্রও সেই পথেই হাঁটতে বাধ্য হলেন। সিপিএমের আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে মমতার তর্জন গর্জনই সার-রাজ্যর ওপর আরো ধার চাপিয়ে বেতন মেটানোর কবর কাটার খেলা অব্যহত। কলেজ কর্মচারীদের বেতন এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বকেয়া মেটাতে পারছে না রাজ্য সরকার। এই সংকট থেকে বেড়োনোর জন্যে রাজ্যের উপায় বাড়ানোর দরকার। প্রণব এবং মনমোহন একথা বারবার সিপিএমকে বলেছেন-মমতাকেও বলছেন। কেওই শুনছে না। কারন সেটা করতে গেলে কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত-যেমন বর্ধিত কর, বিদ্যুতের বর্ধিত মাশুল , বিদ্যুত চুরি বন্ধ করা, রাস্তার ওপর টোল ট্যাক্স বসানো, অনাবাদি জমিগুলিকে শিল্পের জন্যে উচ্চদামে লিজ দেওয়া ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মমতা জনগণের ওপর বর্ধিত বোঝা চাপাতে চান না। ভাল কথা। সেটা একটা রাজনৈতিক লাইন হতেই পারে। কিন্ত আয় না বাড়ালে, অন্য উপায় খরচ কমানো। কিন্ত সে পথ চালু করলে ( যেটা না চাইলেও উনাকে করতেই হবে) রাজ্য সরকারের সব শুন্যপদে নিয়োগ বন্ধ, নতুন শিক্ষক নেওয়া বন্ধ করতে হবে। যেটি আরো বাজে সিদ্ধান্ত-এবং সেইভাবে শেষ রক্ষা হবেও না-কারন সরকারি খরচ কমানোর জায়গা আর বিশেষ কিছু নেই।
মোদ্দা কথা মমতার অর্থনৈতিক লাইন সিপিএমের থেকে আলাদা কিছু না। সেই বল্গাহীন পপুলিজম যা একটা রাজ্যকে সর্বনাশ ছারা আর কিছু দিতে পারে না।
এবার আসা যাক রাজ্যে স্বাস্থ্যের অবস্থা নিয়ে। মমতার পরিদর্শনে বা সাসপেনশনে কাজ কি কিছু হয়েছে? শিশুমৃত্যুর হার এবং চিকিৎসায় অবহেলা অব্যাহত। আমি ছমাস আগেই লিখেছিলাম নাটক করে, এসব কিস্যু হবে না। সুস্থ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এ ধরনের কেন্দ্রীয় কাঠামোতে হবে না। দরকার ক্ষমতা এবং দ্বায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরন। দরকার পেশাদার হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের লোক এবং তাদের হাতে ক্ষমতা । মমতা কি করলেন? একটা ভাঙা বাড়িতে এলেন। ছাদে ফুঁটো আছে দেখে বললেন-এই এখানে প্লাস্টার মার। ভাঙা বাড়ি প্লাস্টার মেরে সারানো যায় না। দরকার পুড়ানো জরাজীর্ন বাড়িটিকে ভেঙে, নতুন করে বাড়ি বানানো। পশ্চিম বঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এমন ধ্বংস প্রাপ্ত, সিপিএম পার্টির উচ্চ স্থানীয় নেতা ত দূরের কথা, পার্টির ক্যাডাররা পর্যন্ত কিছু হলে নার্সিং হোমে ছুটত। তাদের দ্বিচারিতার শাস্তি জনগণ দিয়েছে-এবং আরো কড়া কিছু শাস্তি তারা পঞ্চায়েত নির্বাচন বা আগামী লোকসভা নির্বাচনেও পাবে। কিন্ত সিপিএমের বিরুদ্ধে এই নেগেটিভ আবহ বেশীদিন চলবে না। এর মধ্যেই মমতাকে স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে হবে।
মোদ্দা কথা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। নাটক বন্ধ করে, মমতার উচিত অবিলম্বে হাসপাতাল ম্যানেজমেন্টের লোক এনে, হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট সম্পূর্ন বদলে দেওয়া।
এবার আসি শিক্ষা প্রসঙ্গে। প্রেসিডেন্সি, শিক্ষার উৎকর্ষতা এসব নিয়ে ফালতু সময় নষ্ট করছে রাজ্য সরকার। শিক্ষার উদ্দেশ্য ভবিষ্যতের জন্যে আরো উৎপাদনশীল কর্মক্ষম নাগরিক তৈরী-যারা হবে উৎপাদন ব্যবস্থার জন্যে আরো বেশী উপযুক্ত। এর জন্যে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার মান আরো বাড়ানো দরকার। স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার, কমিউনিকেটিভ ইংলিশ , একাঊন্টিং , টাইপিং, মার্কেটিং , ম্যানেজমেন্টের প্রাথমিক শিক্ষাগুলি দেওয়া দরকার। এগুলি আমেরিকাতে দেখছি ভীষন ভাবে আসছে স্কুলের শিক্ষায়। কারন সবাই পন্ডিত হবে না-সবাই বড় প্রযুক্তিবিদ বা ডাক্তার বা বিজ্ঞানী হবে না। কিন্ত এই উন্নত যন্ত্র সভ্যতায় পশ্চিম বঙ্গের ছেলে মেয়েদের যদি জায়গা করে নিতে হয়, তাদের এই লাইফ-সেভিং স্কিলগুলি বাড়াতেই হবে।
এসব নিয়ে কোন আলোচনা বা চিন্তা ভাবনা চোখে পড়ে না-শুধু প্রেসিডেন্সির মলমূত্র পরিস্কার করার এক্যাডেমিক আলোচনা করে এই রাজ্যের অধিকাংশ ছেলে মেয়েদের কিছু হবে না। মোদ্দা কথা শিক্ষা নিয়ে মমতাতন্ত্রের কোন নতুন চিন্তাধারা দেখতে পাচ্ছি না। সস্তার স্টান্টবাজি চলছে। একটা অমর্ত্য সেন তৈরী করার থেকে এই রাজ্যের অনেক বেশী দরকার দশ লক্ষ "স্কিলড শ্রমিক"।
এবার শিল্পের প্রসঙ্গে আসি। পার্থ চ্যাটার্জি পশ্চিম বঙ্গে শিল্প স্থাপনের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক এবং অমায়িক একজন ব্যক্তিত্ব। কোলকাতায় আমার শিল্পপতি বন্ধুদের কাছ থেকে যা শুনেছি -সেটা নিঃসন্দেহে আশার কথা যে পার্থবাবু সবার সাথে পশ্চিম বঙ্গের শিল্পের উন্নতির জন্যে সাহায্য চেয়েছেন। অনেকেই আগে পশ্চিম বঙ্গে বিনিয়োগ করতে চাইত না-এখন চাইছে। এটা খুব ভাল লক্ষণ চোখে পড়ছে। কিন্ত সমস্যা অন্যত্র।
কিছুদিন আগে নিউ ইয়ার্কে শ্যাম পিত্রোদার সাথে পশ্চিম বঙ্গের হাল হকিকত নিয়ে সামান্য আলাপের সুযোগ হয়েছিল। উনিত এখন মমতার মূল পরামর্শ দাতা। শ্যাম পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান হাল নিয়ে খুবই চিন্তিত কারন এই রাজ্যটি মহারাষ্ট্র বা গুজরাতের থেকে ২০ বছর পিছিয়ে আছে শিল্পকাঠামোতে। আগামী পাঁচ বছর চলে যাবে শুধু শিল্প কাঠামোর উন্নতি করতে। সমস্যা হচ্ছে রাজ্য সরকার সেটা করবে কি করে? জমি অধিগ্রহণ এই সরকার করতে চাইছে না। কাঠামো না পেলে বড় শিল্প আসবে কি করে? শুধু আন্তরিকতার কারনে ত শিল্পপতিরা আসবে না।
এবার দেখা যাক আইন শৃঙ্খলার অবস্থা। এক্ষেত্রেও রাজ্য আছে আগের মতনই। আগে ছিল সিপিএমের গুন্ডামো-এখন তৃণমূলীদের গুন্ডামো এবং ঔদ্ধত্য অব্যহত। অবশ্য এই ব্যাপারে আমি মমতাকে দোষ দিতে চাইছি না। পশ্চিম বঙ্গের রাজনৈতিক সংর্ষের মূল কারন, মাথা পিছু জীবিকা নির্বাহের স্বল্প সংস্থান। বেকারত্ব এবং দারিদ্রর কারনে সীমিত সম্পদের ওপর অনেক লোকের চাপ-- এখানে যা প্রায়শ দুই দলের মারামারি, খুনোখুনির রূপ নিচ্ছে। এই রাজ্যে জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম না হলে, এটা চলতেই থাকবে।
আমি আশাবাদি। মমতার সদিচ্ছা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। কিন্ত তিনি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন না করলে, আদৌ কিছু করতে পারবেন কি না- সেই নিয়ে আমি সন্দিহান।
No comments:
Post a Comment